মুঘল-আফগান দ্বন্দ্ব:
ভারতে মুঘল শক্তির উত্থান ও বিকাশের সঙ্গে মুঘল আফগানি দ্বন্দ্বের সমান্তরাল অবস্থান দেখা যায়। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুঘল আফগান দ্বন্দ্ব চলতে থাকে।
খানুয়ার যুদ্ধ: ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে মেবারের রানা সংগ্রাম সিংহের সঙ্গে বাবরের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধে রানা সংগ্রাম সিংহ পরাজিত হন। এই যুদ্ধে রাজপুতদের সঙ্গে আফগানরা সহযোগিতা করেনি। রাজপুতদের সঙ্গে সঙ্গে আফগানরাও যদি মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করত তাহলে হয়ত ভারতের ইতিহাসের গতি অন্য পথে প্রবাহিত হতে পারত।
ঘর্ঘরার যুদ্ধ (১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ): বাবর আফগানদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে বিহারের সীমান্তে পৌঁছান। পূর্ব ভারতে মুঘল আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য জৌনপুরের শাসনকর্তা মামুদ লোদি বিহারের আফগান নেতা শেরশাহ, এবং বাংলার সুলতান মুঘল শক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত ঐক্যশক্তি জোট গঠন করেন। বাবর নুসরৎশাহের কাছে দূত পাঠিয়ে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করতে বলেন। এর পর মামুদ লোদি, ও শেরশাহ মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বাবর এলাহাবাদ, বারাণসী দখল করে বিহারের আরো জেলা অধিকার করার জন্য প্রবেশ করলে উভয় পক্ষে যুদ্ধ বাধে। আফগানরা পরাজিত হয়। নসরত শাহ বাবরের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। ফলে আফগানদের রাজনৈতিক প্রভুত্বের সম্ভাবনা সাময়িক ভাবে বিলুপ্ত হয় এবং মুঘল সাম্রাজ্য বিহার পর্যন্ত সুবিস্তৃত হয়।
শেরশাহের সঙ্গে হুমায়ুনের বিরোধ: বিহারের আফগান জায়গিরদার শেরশাহ বিহার ও বাংলায় একাধিক অভিযান করেন এবং আফগানদের সংঘবদ্ধ করতে উদ্যোগী হন। শেরশাহ বিহারে নিজ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দ শেরশাহ বাংলার রাজধানী গৌড় আক্রমণ করেন। শেরশাহ শক্তি বৃদ্ধিতে ভীত হয়ে ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহ অর্ন্তভুক্ত অঞ্চল চুনার দখল করেন। এর পর হুমায়ুন গৌড় অবরোধ করলে তাঁর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে গৌড় ছেড়ে চলে যান। হুমায়ুনের বাংলায় থাকাকালীন শেরশাহ বারাণসী, জৌনপুর ও কনৌজ অধিকার করেন, হুমায়ুন ভীত হয়ে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। বক্সারের কাছে চৌসা নামে এক স্থানে হুমায়ুন ও শেরশাহ মধ্যে যুদ্ধ হয়। হুমায়ুন পরাজিত হন এবং আগ্রায় পালিয়ে যান। এর ফলে বাংলা, বিহার, জৌনপুর শেরশাহের দখলে চলে আসে।
কনৌজের যুদ্ধ (১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ): ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন এক বিশাল সৈন্য বাহিনী নিয়ে শের খাঁর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। কনৌজের কাছে শেরশাহ ও হুমায়ুনের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে হুমায়ুন পরাজিত ও সিংহাসনচ্যুত হয়ে পালিয়ে যান। এই যুদ্ধের ফলে শের খাঁ ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে আবার আফগান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
কাবুল ও কান্দাহার জয়লাভ: আশ্রয়ের জন্য অবশেষে হুমায়ুন সিন্ধুদেশে উপস্থিত হন। এর পর রাজা মালদেবের আমন্ত্রণে মাড়কারের দিকে অগ্রসর হন হুমায়ুন। কিন্তু মালদেব শেরশাহের সঙ্গে চুক্তি করে হুমায়ূনকে বন্দি করতে সচেষ্ট হলে তিনি আবার সিন্ধু অঞ্চলে ফিরে আসেন। হুমায়ুন কামরানের নিকট সাহায্য চাইলে কামরান তাঁকে বন্দি করতে উদ্যোগী হন এর পর তিনি পারস্যের শাহ আহম্মদের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি হুমায়ুনকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। এই সৈন্য বাহিনীর সাহায্যে কাবুল ও কান্দাহার জয় করেন ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং চুক্তির শর্ত অনুসারে কান্দাহার পারস্যের শাহ আহমদকে দান করেন।
মুঘল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা: অল্প দিনের মধ্যেই পারস্যের শাহর মৃত্যু হলে হুমায়ুন কান্দাহার নিজ অধিকারে আনেন। অন্যদিকে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শেরশাহের মৃত্যু হয়। ফলে আফগান শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। শেরশাহের বংশধরদের মধ্যে বিবাদের সুযোগে হুমায়ুন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে লাহোর জয় করেন এবং সিকন্দর শুরকে পরাজিত করে দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করেন। তিনি আবার মুঘল সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল আফগান দ্বন্দ্বের শেষ পর্যন্ত অবসান হয় এবং মুঘলরা স্থায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ করে।